মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন
অর্থনৈতিক ডেস্ক:: দেশে মসলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে সরকার। মসলার আমদানি নির্ভরতা কমানোই এর মূল লক্ষ্য। এ জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মসলা কৃষি পণ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রধান শস্যগুলোর পাশাপাশি এর চাষ কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে যেমন সহায়ক, তেমনই মোট কৃষি অর্থনীতিকেও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক। বর্তমান বিশ্বে ১০৯ ধরনের মসলা চাষ করা হলেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৪৪টি মসলা। এর মধ্যে চাষ করা হয় মাত্র ৩৪টি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মসলার জমি চলে এসেছে খাদ্যশস্য চাষের আওতায়। এ কারণে মসলার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে মসলা আমদানি করে এ ঘাটতি পূরণ করা হয়। তাই সরকার মসলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার জন্য একটি পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি হলো ‘বাংলাদেশ মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ’।
গৃহীত প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে এই অর্থ। ২০১৭ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৩০ জুন মেয়াদকালে বাস্তবায়িত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের ৬৪টি জেলার ১৯৪টি উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করবে বগুড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)। ইতোমধ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান কার্যালয়ের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও পাঁচটি উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
বিএআরআই সূত্র জানায়, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি ও মানসম্মত মসলার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও আয় বাড়িয়ে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এর অংশ হিসেবে মসলা জাতীয় ফসলের টেকসই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গবেষণা কেন্দ্রটি বিভিন্ন মসলা ফসলের ৩৩টি উচ্চ ফলনশীল জাত ও ৮৪টি উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ও ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
অধিকাংশ প্রধান মসলা যেমন- পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, হলুদ, ধনিয়া এবং অপ্রধান মসলা যেমন- মেথি, কালোজিরা, বিলাতি ধনিয়া, পান প্রভৃতির চাষের জন্য বাংলাদেশের কৃষিতাত্ত্বিক আবহাওয়া উপযোগী ও সম্ভাবনাময়। কিন্তু চাহিদার কারণে কিছু বিদেশি মসলা পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। তাই আমদানির নির্ভরতা কমানো ও কাঙ্ক্ষিত মসলা উৎপাদন অর্জনের লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে সরকার।
বিএআরআই সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে- মসলার নতুন জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্তিকরণ, প্রজনন বীজ উৎপাদন, অঞ্চল ও সমস্যা ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন প্যাকেজ তৈরি, মসলা ফসলের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন বীজ বপন, রোপন, বীজ ও চারা, কলম ইত্যাদি উৎপাদন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির উন্নয়ন, সেমিনার ও কনফারেন্স হল, কাভার্ড থ্রেশিং ফ্লোর, গ্রিন হাউস, মিস্ট হাউস, কোল্ড রুম, বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, মাঠদিবস ও মোটিভেশনাল ট্যুর, স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে গত ২০ বছরে মসলার উৎপাদন আট গুণ বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মসলার চাহিদা। দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার হয়। সারাবছর ব্যবহৃত মসলার পরিমাণ ৬০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ মসলা আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ মসলার চাহিদা মেটে আমদানির মাধ্যমে। তবে ঠিক কী পরিমাণ মসলা সারাবছর ব্যবহার করা হয় সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
দেশে ব্যবহৃত মসলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আদা, হলুদ, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, কালোজিরা, গোলমরিচ, জাউন, শলুক, আলুবোখারা, বিলাতি ধনিয়া, ধনিয়া, চিপস, সাদা এলাচ, কালো এলাচ, দারুচিনি, জাফরান, তেজপাতা, জিরা, মেথি, শাহি জিরা, পার্সলে, কাজুবাদাম, পানবিলাস, দইং, কারিপাতা, পাতা পেঁয়াজ, লেমনগ্রাস, ভাদুরি পাতা, পুদিনা, কিশমিশ, অলস্পাইস, শটি, আমআদা, চৈঝাল, একানি, মৌরি, পেস্তাবাদাম, জয়ফল, জয়ত্রি, ভ্যানিলা, লবঙ্গ, ডালফিরিঙ্গি ও রাঁধুনি।
কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মসলার উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৯ লাখ টন। এসব মসলার চাষ হয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কাঁচামরিচ ৬ লাখ ৫৮০ টন, শুকনা মরিচ ২ লাখ ২৬ হাজার ৩১১ টন, পেঁয়াজ ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৪ টন, রসুন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৩৩ টন, আদা ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৩ টন, হলুদ ৩ লাখ ১৫ হাজার ৪২২ টন, দারুচিনি সাড়ে ৯ টন, তেজপাতা ২ হাজার ১৫৩ টন, কালোজিরা ১২ হাজার ৯১৯ টন, ধনিয়া ৭০ হাজার ৪৬৫ টন, গোলমরিচ ৬ টন ও অন্যান্য মসলার উৎপাদন হয়েছে ৫ হাজার ৪৭ টন।
২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হলুদ, দারুচিনি ও গোলমরিচ আমদানি হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টন। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৭৯১ টন হলুদ আমদানি হয়েছিল, যা পরের বছর বেড়ে পৌঁছায় ৮ হাজার ৫৮১ টনে। ২০১৫ সালের তুলনায় দারুচিনি আমদানি কিছুটা বেড়েছে। ওই বছর আমদানি হয়েছিল ৯ হাজার ৪৮১ টন। ২০১৬ সালে আমদানি হয় ১০ হাজার ২৮৬ টন। আর ২০১৬ সালে গোলমরিচ আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৪১ টন।
দেশে উৎপাদিত মসলার পরিমাণ ৩৫ লাখ টনেরও বেশি। আর প্রতি বছর অতিরিক্ত ১৪ লাখ টন মসলার চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বছরে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৪টি মসলার ৩১টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যেগুলো মাঠপর্যায়ে চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রসুন, পেঁয়াজ, মেথি, ধনিয়া, মৌরি, গোলমরিচ, কালো জিরা, পান, বিলাতি ধনিয়া ও আলুবোখারার বেশকিছু জাত সফলভাবে উদ্ভাবন করেছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র।
প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এর সুফল দেশবাসী পাবেন বলে আশাবাদী বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রয়োজনীয় মসলার উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আমদানি ও দাম কমবে। এক্ষেত্রে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে দেশে মসলা উৎপাদনে গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে সরকার। সেজন্য এই প্রকল্প।’