মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৭:৩৩ অপরাহ্ন
একুশের নিউজ ডেস্ক ॥
বিদেশে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানব পাচার থেমে নেই। এই ফাঁদে পা দিয়ে মাদারীপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, মেহেরপুর ও রাজশাহী থেকে দালালদের কথামতো ইতালি, দুবাই, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের পথে রওনা হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু তাদের লোভের ফল হয়েছে উল্টো। বরং চাকরি পাওয়া তো দূরে থাক, তারা জিম্মি হয়েছেন মানব পাচার চক্রের হাতে। তাদের চাহিদামতো মুক্তিপণের মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন পরিবার পরিজন। টাকা দিতে না পারলে বিদেশের পথে পা বাড়ানোদের ভোগ করতে হচ্ছে পৈশাচিক নির্যাতন। একপর্যায়ে অনেকেই হচ্ছেন লাশ। কারও কারও সমুদ্রেও সলিল সমাধি ঘটছে।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ- মাদারীপুর : মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দক্ষিণ চরকামারকান্দি গ্রামে কমপক্ষে ৫০ যুবককে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে আবুল কালাম মুন্সি নামে এক আদম দালালের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, দালালচক্রের সদস্যরা প্রথমে ইতালিতে উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে আগ্রহী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেওয়া হয় সংঘবদ্ধ মাফিয়াদের হাতে। এরপর তাদের নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে দেখিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। কোনো পরিবার মুক্তিপণ দিতে রাজি না হলে আটক ব্যক্তিদের দিতে হয় জীবন।
মাদারীপুরে অর্ধশতাধিক যুবককে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে দালাল আবুল কালাম মুন্সির বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও জামিন নিয়ে তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে জেলা পুলিশ বলছে, দ্রুত দালালদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দা বিএম রাসেল বলেন, ‘আমাদের একই গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন আবুল কালামের কাছে টাকা দিয়েছিল ইতালি যাওয়ার জন্য।
বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৪০-৫০ লাখ করে টাকা নিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের সঙ্গেই এখন পরিবারের যোগাযোগ নেই। বেঁেচ আছে নাকি মারা গেছে তাও জানে না পরিবারের লোকজন। এই দালালের প্রলোভনে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন অনেকে। নির্যাতন করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি।
এরকম একজন মাসুম মোল্লার বাবা আবদুল রহিম মুন্সি বলেন, আমার ছেলেকে প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমার ভিটামাটি যা ছিল সব বিক্রি করে এদের ৫১ লাখ টাকা দিছি। আমার ছেলে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানি না। আমরা এর বিচার চাই।’ আরেক নিখোঁজ সোহেল আহমেদের ভাই বিএম রুবেলও অনুরূপ কথা বলেন।
ভাঙ্গা (ফরিদপুর) : ভাঙ্গায় সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সংখ্যা কম নয়। দালালদের খপ্পরে পড়া, পথিমধ্যে দালালচক্রের হাতে দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হওয়া, দালালদের প্রলোভনে টাকা খোয়ানো, সর্বোপরি নৌকা বা ট্রলারযোগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়াসহ অসংখ্য ঝুঁকি মেনে নিয়েই ভাঙ্গার একশ্রেণির যুবক অভিভাবকের প্ররোচনায় দেশ ছাড়ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য অবৈধ পথে হলেও স্বপ্নের ইতালি যাত্রা। স্বপ্নযাত্রা পরিণত হচ্ছে শবযাত্রায়। তারপরও এ নেশা ছাড়ছে না ভাঙ্গার অসংখ্য যুবক ও তাদের অভিভাবকদের। এভাবে ভাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অসংখ্য লোক বিদেশে যাচ্ছে। এভাবে অবৈধ পথে বিদেশে বেশি যাচ্ছেন ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া, আজিমনগর ও কালামৃধা ইউনিয়নের যুবকেরা।
রাজবাড়ী : রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার বাহাদুর ইউনিয়নের পাটকিয়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা রাশিদুল ইসলাম রিফাত (২২)। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুবাই যান। সেখান থেকে জিম্মি করে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যায় একটি চক্র। সেখান থেকে মিয়ানমারের একটি গহিন জঙ্গলে নিয়ে শুরু করে নির্যাতন। রিফাতের মতো ৩০০ জনের বেশি বাংলাদেশি সেখানে জিম্মি রয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
এমন অভিযোগ করে গত বছরের নভেম্বর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রিফাতের পিতা আ. হাকিম সরদার। ছেলে উদ্ধারে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত রিফাতের পিতা। রিফাতের বোন মৌসুমি আক্তার বলেন, আমার ভাইকে জিম্মি করেছে চাইনিজ মাফিয়া নামের একটি গোষ্ঠী। আমার ভাই গোপনে নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি পাঠিয়েছে। সেগুলো খুবই হৃদয় বিদারক। মাফিয়া গোষ্ঠী আমার ভাইয়ের মুক্তির জন্য ৫০ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করছে। ভাইকে উদ্ধারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।