শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন
সাইদুল ইসলাম::
সংলাপ সবসময়ই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ও সুশীল সমাজের একটি জাতীয় দাবি। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন কিংবা দেশের বিশেষ কোন সংকটের সময় সংলাপের এই দাবি আরো জোরালো হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার নানা টানাপড়েনের ও শর্তারোপের কারণে সংলাপ আর হয় না। ২০০৬ সালের ৪ঠা অক্টোবর সর্বশেষ সংলাপ হয়েছিল বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূইয়া ও আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের মধ্যে। তিনদিন ধরে চলা সে সংলাপও শেষ অবধি ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে দু’বছরের জন্য জাতির ঘাড়ে ওয়ান ইলেভেন নামক এক অগণতান্ত্রিক ভূত চেপে বসেছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১০ই মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রীম কোর্টের আংশিক একটি রায়কে পুঁজি করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এবং দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান চালু করে। ফলশ্রুতিতে জাতীয় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় এবং তা দিন দিন আরো ঘনিভূত হতে থাকে। পাশাপাশি একে একে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও আসতে থাকায় জাতীয় রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাথে যোগ হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতের আন্দোলন। এই যখন অবস্থা তখন রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যকার সংলাপের দাবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে আরো জোরালো হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ও তার দূত বার বার তাগাদা দিতে থাকেন সংলাপের জন্য।
কিন্তু কে শুনে কার কথা। জাতীয় স্বার্থের কাছে যখন ব্যক্তি আক্রোশ গৌণ হয়ে যায় তখন আতœসহংবোধ সম্পন্ন জাতি কেউ কারো কাছে ছোট হতে চায় না। তার পরও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দায়িত্ববোধ থেকে হোক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হোক স্ব উদ্যোগে বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। ফোনালাপের বিষয়বস্তুতে যেতে চাই না। শুধু এটুকুই বলবো ওনাদের ব্যাক্তিগত অসহিষ্ণুতা ও অদূরদর্শিতা জাতিকে হতাশ করেছিল, এবং ৫ই জানুয়ারির মত একটি তামাশাভরা নির্বাচনী ছেলেখেলা দেখতে হয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের। এর দায় যেমন সরকারের ছিল তেমনি বিরোধীদলের কোন অংশে কম নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলের কাজ হচ্ছে জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও গণতন্ত্রের পাহারায় অবতীর্ণ হওয়া। অত্যুক্তি না হলে বলবো, বিএনপি খামখেয়ালিপনার কারণে সেদিন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল।
পরবর্তীতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ইন্তেকালের খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, ছেলে হারানো এক শোকার্ত মাকে সমবেদনা জানাতে। কিন্তু আমাদের নূন্যতম রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌহার্দের কোন চর্চা না থাকায় প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন দশ মিনিট গেটে দাঁড়িয়ে থেকে গেট খুলে না দেয়ায় ফিরে আসতে হয়েছে। এই ঘটনায় তিনি বিব্রত ও অপমানবোধ করেছেন এবং পুরো বাংলাদেশও বিব্রত হয়েছিল।
১০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর গত চার বছর থেকে বিএনপি সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা বলে আর অপমানিত হতে চায় না বলে বার বার সংলাপ প্রত্যাখান করা হচ্ছে। বরং ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে হজম করে বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকা সরকার গৃহপালিত বিরোধীদলকে নিয়ে স্বভাবত আয়েশেই টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুতরাং সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপে বসার কোন লক্ষণ নেই।
এটা সত্য যে দেশে একটি সরকার আছে, সংসদ আছে, বিরোধীদল আছে। কিন্তু কোন কিছুরই জবাবদিহিতা নেই, আইনের শাসন নেই, নেই প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা। যা হয় তা শুধু স্তুতি গাওয়া, সরকার ও গৃহপালিত বিরোধীদল মিলে ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়া আর কি। তাই মাঠের বিরোধীদলের প্রধান ও বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া নিজে দায়িত্ব নিয়ে একটি সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি চাইলে সংলাপের মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে বাধ্য করতে পারেন। সবকিছু যে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করতে হবে তা কিন্তু নয়।
সময়ের পরিক্রমায় দাবি আদায়ের কৌশলও ভিন্ন হতে পারে। সুতরাং তিনি যদি নিজে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে নিজ বাসায় চায়ের দাওয়াত দেন, এতে করে বেগম জিয়ার ছোট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং তখন রাজনীতির চেহারা পাল্টে যাবে এবং তা বেগম জিয়া ও তাঁর দলকে রাজনীতির মাঠে আরো কৌশলী ও শক্তিশালী করবে। এবং এই উদ্যোগ সরকারও প্রত্যাখান করতে পারবে না। কারণ বেগম জিয়া সংসদ ও সরকারি কোন পদে না থাকলেও তাঁর একটি ফোনকলের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে শেখ হাসিনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এর পরও যদি সরকার সংলাপে না বসে সংলাপ প্রত্যাখান করে আবারো একমুখী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় তখন নিশ্চয়ই জনগণ আপনি এবং আপনার দলের পাশে থাকবে। কারণ জনগণও এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি চায়। সবকিছুর পরে দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য আপনার এই উদ্যোগ আপনাকে আরো মহিমান্বিত করবে এবং গণতন্ত্রের ইতিহাসে আপনি চির অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবেন। সুত্র: আমাদের সময়.কম