রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৪ অপরাহ্ন
মজিবুর রহমান , সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি।।
উন্নত জীবনের আশায় ইতালির যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কৃষকের একমাত্র ছেলে শাকিল মিয়া (২৪)। আর সেই স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করতে কয়েকমাস আগে ১২ লাখ টাকা চুক্তিতে দালালের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্য রওয়ানা হন তিনি।
কিন্তু দালালরা তাকে ইতালির বদলে লিবিয়ায় নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে তাকে আটকে রেখে দালালরা আরও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে শুরু করেন নির্যাতন। এতে শাকিলের ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিনত হয়।
একপর্যায় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শাকিল লিবিয়া থেকে দেশে তার বাবাকে ফোন করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আব্বা কবে টাকা দিবা, ওরা (দালালরা) আমাকে খাবারও দেয় না।
উত্তরে দালালদের উদ্দেশ্যে বাবা বলেন, ভাই আপনাগো দোহাই আল্লাহর ওরে মাইরেন না। আমি যেভাবেই পারি টাকা দিব। কিডনি বেইচ্যা হলেও টাকা দিব। এরপর শাকিল বলেন, আব্বা টাকা দিতেই হবে, আর নয় ওরা (দালালরা) আমাকে মাইর্যা ফেলবে।
লিবিয়ায় নির্যাতিত শাকিল ও তার বাবা এবং দালালদের কথোপকথনের একটি কল রেকর্ডে এসব কথা শুনা যায়। শাকিল ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তুপুর গ্রামের কৃষক টুটল মিয়ার একমাত্র ছেলে।
শাকিলের পবিরাব জানান, গত জানুয়ারিতে প্রতিবেশী মুকুল ঠাকুর নামে এক দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখে শাকিল মিয়া। পরে তার কথামত ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি লিবিয়ায় পৌছায়।
এরপরই তার উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। বর্তমানে বিলিয়ায় প্রতিদিনই শাকিলকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করে তাঁর পরিবারের কাছে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করছে চক্রটি। এই জন্য আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। টাকা না দিলে মেরে ফেলবে বলে জানানো হচ্ছে।
এদিকে একমাত্র সন্তানের এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে গেছে হতদরিদ্র বাবা টিটুল মিয়া। বাড়িতে চলছে সন্তানকে ফিরে পেতে আহাজারি। অসহায় হয়ে পড়েছে তার মা-বাবা। বিগত কয়েকদিন ধরে খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে তাদের।
তার মা রাবেয়া বেগমের আহাজারীতে কাঁদছে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনেরা। কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। পুরো গ্রামে বিরাজ করছে শোক। সন্তানের জীবন রক্ষায় আকুতি মিনতি ও কোন কথায় কাজে লাগছে না মানব পাচারকারী চক্রের কাছে, তাদের দাবি আরো ১৫ লক্ষ টাকা পাঠাতে হবে।
শাকিলের বড় বোন বৃষ্টি আক্তার জানান, গত ৪ জানুয়ারি প্রথমে ভারতে নেয়া হয়, পরে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে গত ১২ দিন যাবৎ অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রেখেছে চক্রটি। নির্যাতনের সময় কল দিয়ে শুনানো হয়। নির্যাতনকারীর এদেশেরই, তারা বাংলায় কথা বলে।
তিনি আরও জানান, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মুকুল ঠাকুর কিছুদিন আগে দেশে আসে। দেশে এসে যুবসমাজকে লিবিয়া থেকে ইতালিতে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করার একপর্যায়ে শাকিলকে ইতালি নিয়ে সেখানে উচ্চ বেতনে চাকুরীর লোভ দেখিয়ে প্রভাবিত করে ফেলে। পরে মুকুলের ফাঁদে পড়ে পিতা-মাতার শত চেষ্টা উপেক্ষা করে লিবিয়া যাওয়ার বায়না ধরে বসে শাকিল। আদুরে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ও তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অসহায় পিতা-মাতাও তার কথায় রাজি হয়।
পরে মুকুল জানায়, সর্বমোট ১২ লক্ষ টাকা দিলে সে শাকিলকে বৈধভাবে ইতালিতে নিয়ে গিয়ে উচ্চ বেতনে চাকুরির ব্যবস্থা করে দিবে। মুকুলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে, জমিজমা বন্ধক রেখে ও চড়া সুদে ঋণ করে ১২ লক্ষ টাকা জোগাড় করে তুলে দেয় মুকুলের হাতে। একইভাবে শাকিলসহ ৪ জনের কাছে থেকে মোট ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে লিবিয়ায় ফিরে যায় মুকুল।
এর কিছুদিন পরে শাকিলসহ আরো ৪ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ায় নিয়ে শাকিলের পিতা-মাতার কাছে পুনরায় আরো ১৫ লক্ষ টাকা দাবী করে বসে এই মুকুল ও তার চক্রের লোকজন।
শাকিলের বাবা টিটুল মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি এত টাকা কোথায় পাব। যা ছিলো শেষ সম্বলটুকু বিক্রয় করে, চড়া সুদে ঋন নিয়ে ১২ লক্ষ টাকা জোগাড় করো আগেই তো এই পাচারকারী মুকুলের হাতে তুলে দিয়েছি। এখন কোথায় যাবো?
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান বালী বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। এখন তাকে উদ্ধারের জন্য পরিবার যদি কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সহযোগিতা করা হবে। ঢাকায় এ্যাম্বাসিতে যোগযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া তার পরিবার যদি অভিযোগ দেয়, তাহলে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।